করোনাঃ চাঁদপুরে মৃত্যু ৫ গুণ বেশি, মোট ৮২ জন
বাংলাদেশে ‘করোনাভাইরাস ডিজিস ২০১৯’ (কভিড-১৯)-এ আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর হার ১.৩৪ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি আক্রান্তের শহর ঢাকায় এই হার ১.৪৩। কিন্তু চাঁদপুরে এই হার ৭.৭৪ শতাংশ। অন্যান্য জেলার তুলনায় চাঁদপুরে করোনা উপসর্গে মৃত্যুর ঘটনাও বেশি ঘটছে। সেখানে জ্বর-কাশি ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে প্রতিদিনই গড়ে চার থেকে পাঁচজনের মৃত্যু হচ্ছে।
স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা মনে করেন, করোনার উপসর্গ থাকার পরও অনেকেই নানা কারণে হাসপাতালে যাচ্ছে না। বাড়িতেই ‘গোপনে’ চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছে। এ কারণে মৃত্যুর হার বেড়ে যাচ্ছে। আবার হাসপাতালেও নানা সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, শনিবার পর্যন্ত চাঁদপুরে করোনা রোগীর সংখ্যা ছিল ৪১৩ জন। করোনায় আক্রান্ত হয়ে এবং উপসর্গ নিয়ে মৃত্যু হয়েছে ৮২ জনের। এদের মধ্যে নমুনা পরীক্ষায় শনিবার পর্যন্ত যাদের ফল পাওয়া গেছে, তাতে ৩২ জনের শরীরে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। সবার নমুনা পরীক্ষা সম্পন্ন হলে করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা স্বাভাবিকভাবেই আরো বেড়ে যাবে।
জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, সদর উপজেলায় করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ১৫৭। করোনায় আক্রান্ত হয়ে কিংবা উপসর্গ নিয়ে মৃত্যু হয়েছে ২৩ জনের। এদের গতকাল পর্যন্ত ১০ জনের নমুনায় করোনাভাইরাস পাওয়া গেছে। হাজীগঞ্জে আক্রান্তের সংখ্যা ৪৯। করোনায় আক্রান্ত হয়ে কিংবা উপসর্গ নিয়ে সেখানে মৃত্যু হয়েছে ২৭ জনের। শাহরাস্তিতে এই সংখ্যা ১০; আক্রান্তের সংখ্যা ৪৮। মতলব উত্তর ও দক্ষিণে আক্রান্তের সংখ্যা যথাক্রমে ১৯ ও ৩৮। করোনায় আক্রান্ত হয়ে কিংবা উপসর্গ নিয়ে সেখানে মৃত্যু হয়েছে ৯ জনের। হাইমচরে আক্রান্তের সংখ্যা ২৫। করোনায় আক্রান্ত হয়ে কিংবা উপসর্গ নিয়ে মৃত্যু হয়েছে পাঁচজনের। কচুয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা ২৮; করোনায় আক্রান্ত হয়ে কিংবা উপসর্গ নিয়ে মৃত্যু হয়েছে চারজনের। ফরিদগঞ্জে আক্রান্ত ৪৯ জন, করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে চারজনের।
পরিবেশবিদ ও চাঁদপুর পুরানবাজার কলেজের অধ্যক্ষ রতন কুমার মজুমদার বলেন, ‘করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণের এখন পর্যন্ত স্বীকৃত পদ্ধতি হলো মানুষকে ঘরে রাখা। এ ছাড়া ভাইরাসটি আমাদের দেশে যখন ছড়িয়ে পড়ে প্রথম পর্যায়ে তা শনাক্ত করা যায়নি। এতে অনেক আক্রান্ত ব্যক্তি ফাঁকফোকর গলে পরবর্তী পর্যায়ে চাঁদপুরে ঢুকে পড়ে। যে কারণে এই জেলায় পর পর তিনবার লকডাউন দিয়েও কাউকে ঘরে রাখা সম্ভব হয়নি। তারই ফলে কমিউনিটি ট্রান্সফার হয়েছে। ফলে এখন করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েই যাচ্ছে।’
গত মার্চে কয়েক হাজার প্রবাসী বিভিন্ন দেশ থেকে চাঁদপুরে ফেরেন। জেলা প্রশাসনের ভাষ্য, কোয়ারেন্টিনে রাখায় প্রবাসীদের মাধ্যমে করোনা ছড়াতে পারেনি।
মতলব উত্তর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. নুশরাত জাহান মিথেন বলেন, ‘চাঁদপুরের পাশের জেলা নারায়ণগঞ্জে যখন করোনার প্রকোপ শুরু হয়, তখনই দল বেঁধে মানুষজন চাঁদপুরে গ্রামের বাড়িতে ছুটে আসে। পরিবার-পরিজন নিয়ে ছুটে আসা এসব মানুষ থেকেই এই জেলায় করোনার সূত্রপাত ঘটে থাকতে পারে।’
চাঁদপুরে মৃত্যুর হার বেশি হওয়ার কারণ প্রসঙ্গে জেলা সিভিল সার্জন ডা. সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, ‘চাঁদপুর শহর এবং গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ অসচেতন। অনেকে আক্রান্ত হয়েও পাত্তা দেন না। অনেকেই রোগ গোপন করে বাড়িতেই চিকিৎসা নিতে গিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর শিকার হয়।’ তিনি আরো বলেন, ‘শেষ মূহূর্তে যাদের হাসপাতালে আনা হয়, তাদের বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়ে।’
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হাসপাতালে গেলে চিকিৎসা মিলবে না—এমন ভাবনা থেকে অনেকে আক্রান্ত হয়েও বাড়িতে অবস্থান করে।
চাঁদপুর জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল কর্মকর্তা ডা. সুজাউদৌলা রুবেল জানান, বেশির ভাগ রোগীকে স্বজনরা নিয়ে আসে শেষ মুহূর্তে। ওই সময় কেন্দ্রীয় অক্সিজেন ব্যবস্থা এবং আইসিইউ না থাকার কারণে রোগীর জীবন সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে।
করোনা রোগীর চিকিৎসার সীমাবদ্ধতা স্বীকার করে জেলা সিভিল সার্জন বলেন, ‘করোনায় মুমূর্ষু রোগীদের জীবন বাঁচাতে চাঁদপুরে হাইফ্লো অক্সিজেন সাপোর্ট নেই। ফলে হাসপাতালে নিয়ে আসার পর তাদের বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়ছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘তার পরও মৃত্যুর হারের বিষয়টি আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে। প্রতিদিন চাঁদপুরে কেন মৃত্যু বেড়ে চলেছে, তা জানতে রোগীর বিবরণ এবং রোগের লক্ষণ সংরক্ষণ করার জন্য সংশ্লিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছি। পরবর্তী সময়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং মন্ত্রণালয়ে তা প্রতিবেদন আকারে পাঠানো হবে।’