হয়নি বলা বাবার কথা
বাবা, ছোটবেলা থেকেই যাকে আমরা সবাই ভয় পেয়ে এসেছি। পরিবারের আর কাউকে নিয়ে এতো ভয় কাজ করত না। বাবাকে ভয়ে আপনি সম্বোধন করতাম। এতো ঢং করে বাবা বলে কখনই ডাকা হয়নি। আমরা ডাকতাম আব্বা। ঘর জুড়ে বাবার শাসনে সবাই তটস্থ থাকতাম। ছুটির দিনগুলোতে ভাই বোনরা অপেক্ষা করতাম কখন বাবা ঘর থেকে বাইরে কাজে যাবে। বাইরে যাওয়া মাত্রই নিজেদের উদ্যোগে কোন রকমে বানানো ক্যাসেট প্ল্যায়ারে( ফিতার ক্যাসেটে) ফুল সাউন্ডে শুরু হয়ে যেত হালের হিট গান,যার যেটা পছন্দ।
ছোটবোনকে রাখতে হতো জানালার কাছে, দূর থেকে বাবার ফিরে আসা নজর রাখার জন্য। দূর থেকে দেখা মাত্রই চিল্লাইয়া বলত “আব্বা আসতেছে”, কোন রকমে দৌড়ে গিয়ে প্ল্যায়ার থেকে ক্যাসেট বের করে আবার জায়গামতো লুকিয়ে রাখা। বাবা এসেছে ঘরে, সব ঠিকঠাক।যেন কোন গান বাজেনি,লাফালাফি হয়নি,হয়নি কোন চিল্লাচিল্লি । সবাই যার যার মত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছে,ঘরের সবাই তখন ভদ্রলোক। বাবার গান বাজনা খুব একটা পছন্দ না তাই এই অবস্থা। বাবার কড়া নিষেধ, ঘরে বাইরের লোকেদের কোন আড্ডা চলবেনা। তাই বন্ধু বান্ধব নিয়ে ঘরে কোন আড্ডা চলত না। মাঝে মাঝে বন্ধুদের বাসাতেই আড্ডা দিতে যেতে হত।তাও অনুমতি নিয়ে নির্ধারিত সময়ের জন্য। যার জন্য স্কুল কলেজের বন্ধুদের খুব বেশি বাসায় আনা হতো না। বাসায় আনার মত তেমন গোছানো বাসা ও আমাদের ছিলনা।বাবার চাকুরিসূত্রেই জন্মের পর থেকেই ময়মনসিংহে বেড়ে উঠেছি। আমাদের ভাড়া বাসা নিজেদের মত করেই গোছানো। মাঝে মাঝেই বাসা বদল করতে হতো,আবার নতুন করে গোছানো লাগত সবই। ঘর গোছানোর কাজ সবই হতো বাবার নেতৃত্বে।অনেক কিছুই মন মত হতো না, বাবার বাইরে বাইরে পোস্টিং থাকার সুবাদে নিজেদের মত করে আবার ঘর গুছিয়ে নিতাম। সন্ধ্যার আগেই ঘরে ফিরতে হবে বাবার কড়া নির্দেশ। ঘরের কারো সন্ধ্যার পরে বাড়ি ফিরতে হলে বাসায় প্রথমেই বাবাকে মোকাবেলা করতে হত।ঝাড়িঝুড়ি খেয়ে সোজা পড়ার টেবিলে। বাইরে আড্ডায় থাকি আর খেলায় থাকি সন্ধ্যা হলেই সোজা ঘরে।ধীরে ধীরে এগুলো অভ্যেসে পরিনত হয়ে গেছে। বাবা ঘরে না থাকলেও সময়মতই ঘরে ফিরতাম। দূরের স্কুলে ভর্তি হওয়ায় বাবা স্কুলে যাওয়ার জন্য যাওয়া আসার অর্ধেক রিকশা ভাড়া দিত।হেটে যেতাম হেটে বাসায় ফিরতাম, টাকাটা জমে যেত,জমিয়ে আবার বাবার কাছেই ফেরত দিতাম। কারণ, আমি তো জানতাম, ছোট চাকরি করা আমার বাবার দেয়া এই অর্ধেক রিকশা ভাড়ার টাকার মূল্য অনেক। কলেজে ভর্তির পর অবশ্য বাবা একটা সেকেলে ফোনিক্স সাইকেল কিনে দিয়েছিলেন,যখন সহপাঠী অনেকেই গিয়ার ওয়ালা স্টালিশ সাইকেল চালাত। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই বাবার কাছে শিক্ষা পেয়ে বড় হয়েছি,সততা কিভাবে বড় শক্তি হয়ে উঠে শিখেছি, কিভাবে মিতব্যয়ী হতে হবে,কিভাবে নিজেদের জায়গা থেকে নিজেদের একটু গুছিয়ে রেখে আশেপাশের সবার সাথে চলতে হয়, আদব, বুদ্ধি, মহব্বত ও সাহস এই শিক্ষা বাবার কাছে পাওয়া। নিজেদের কাপড় আমরা নিজেরাই পরিস্কার করতাম,নিজেদের কাপড় নিজেরাই লন্ড্রি করতাম, খাবার পর নিজের প্লেট নিজেই ধুয়ে রাখতাম,মাঝে মাঝে ভাই বোনরাই নিজেদের ঘর পরিস্কার করতাম, শিখিয়েছেন বাবা।নিজের কাপড় নিজেই ভাজ করে গুছিয়ে রাখা বাবার কাছে শিখেছি।খুব বেশি জামা কাপড় কেনা হতো না, বাবা অনেক হিসেব করে কাপড় কিনে দিতেন।তাই একটু পরিস্কার আর একটু গুছিয়ে রাখলে বেশিদিন টিকে, এই থিউরি মাথায় গেথে গিয়েছিল।বাবার দেয়া থিউরি। দুই ঈদের কখনই বাবা সবাইকে কাপড় কিনে দিতেন না। বড় ভাই ও বড় বোন বড় হওয়ার সুবাদে নিজেদের পছন্দে কিনে নিত,আর বাকী তিন ভাই আর ছোট বোনকে নিয়ে বাবা নিজেই মার্কেটে নিয়ে প্রায় একই রকমের ঈদের জামা কিনে দিত। বাবা হয়ত বুদ্ধি করেই এক সাইজ বড় দেখেই জামা কাপড় কিনতেন।যাতে ঠিক পরের ঈদ পর্যন্ত টিকে যায়। বাবা কোন নতুন জামা কিনত কিনা ঠিক জানি না।কখনও জানা হয়নি :-(কুরবানি ঈদে নতুন জামা হবে না এটা আমাদের বাসার সবারই জানা ছিল। তাই আগের ঈদের জামাটা সুন্দর করে ভাজ করে আলমারিতে গুছিয়ে রাখতাম। নতুন ট্রেন্ডের কিছু কিনে স্টাইল করার সাহস কখনই হয় নাই।তাতে বাড়তি কিছু টাকা লাগে, সেই টাকা আবদার করার সাহস কখনই হয়নি,ইচ্ছেটাও কখনও তীব্র হয়ে উঠেনি। এক ঈদে হাল ফ্যাশনের সাথে তাল মিলিয়ে কিনলাম জিন্সের স্কিন প্যান্ট।সেই বকা খেয়েছি সেইবার বাবার কাছে।পরে বুঝেছি ঠিক হয়নি,এইসব ফ্যাশন আসলে আমাদের মানায় না। বাবার দেয়া ছোট বেলার অভ্যাসগুলো এখনও ছাড়তে পারিনি, সময় পেলে এখনও নিজের কাপড় নিজেই গুছিয়ে রাখি, সুযোগ পেলেই পুরনো জামা গুলো পড়ে ফেলি,এখনও সন্ধ্যা হলেই ঘরে ফিরতে মন চায়, অফিসে যতই কাজ থাকুক।আমি যে সেন্ডেল ক্যাডস জুতাগুলো পড়ি সেগুলোর কিছু কিছু কম করে হলেও ৩-৪ বছর আগের কেনা, খুব যে দামি কিছু তাও না তবে সুন্দর করে ঘুছিয়ে রেখে পড়ি। এখনও ব্যক্তিগত অফিশিয়াল গুরুত্বপূর্ণ কাগজগুলো বাবার মতই গুছিয়ে সংরক্ষণ করি। এই আমার আজকের অবস্থান, তার পেছনে বাবার অবদান অনেক বেশি। বাবাই যে আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। বাবার সেই কঠিন শাসন আর জীবনের প্রতি ধাপে ধাপে শিক্ষা দেয়া হয়ত তখন খারাপ লাগত, এখন মাঝে মাঝে মনে হয় জীবনে তার প্রয়োজন ছিল। বাবারা আসলেই এমন হয়। বাবা কষ্ট করে হলেও দিন শেষে তার সন্তানের মুখে হাসি সে ফুটাবেই। নিজের স্বার্থগুলো বিলীন করে এই রকম করেই অল্প অল্প করে সন্তানকে মানুষ করে গড়ে তুলেন বাবারা। আমি যে মানুষ হয়ে পথ চলছি তার শিক্ষা এই বাবার কাছেই পাওয়া। ছোট্ট বেলা থেকেই অল্প অল্প করে শিখে এসেছি বাবার কাছে। আজ আমি বড় হয়েছি আর বাবা সেই বাবাই রয়ে গেছেন। সন্তানেরা ঘরে না ফেরা পর্যন্ত দুশ্চিন্তায় মগ্ন থাকেন এখনও।সামান্য অসুস্থ হলে এখনও ফোনের পর ফোন দিয়ে নিজে টেনশনে অস্থির হোন। আমার সকল দু:খে, এখনও দু:খ পায় বাবা। আমার সকল সুখে হোন সুখী।হয়ত কখনও মুখ ফুটে বলেনা, কখনও আমাদের জানাও হয়না।
প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম বাবাদের অবদানটুকু আড়ালেই থেকে যায়। বাবারাই তা আড়াল করে রাখে। তবুও বাবারা জীবনের শেষ অবধি সন্তানের সুখটুকুই আগলে রাখতে চায়, সন্তানের সুখ দেখতে চায় প্রাণ ভরে। সেই সুখ দেখাতেই বাবাদের আনন্দ।আমিও চাই সেই আনন্দ প্রাণভরে। আমার প্রিয় সন্তান ছোট বাবাই Omar Faraz ও যেন পায় সেই আনন্দ তার জীবনের শেষ অবধি।
ভাল থাকুক পৃথিবীর সকল বাবারা,সুখী হোক সকল বাবা। পৃথিবীর সকল সন্তানরা নিজেদেরকে বাবার জায়গায় দাড় করিয়ে বাবাদের ভালবাসুক, অনেক বেশি ভালবাসুক।
কখনও বলা হয়নি-‘বাবা তোমাকে অনেক ভালবাসি।’
লেখক পরিচিতি- উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, পুটিয়া, রাজশাহী।